সকাল সাড়ে সাতটায় লংগদুর একটি জাহাজ পাওয়া গেলেও, আমার সময় অনুযায়ী সকাল দশটায় আরেকটি জাহাজ ছাড়ে। আগের জাহাজের মতোই দুই তলা বিশিষ্ট জাহাজ। উপরের তলায় গ্যালারী সিটের বামে এক পাশে বসলাম, যাতে জানালার পাশে বসে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারি। অবশ্য এর আগে বরকল যাওয়া হলেও সময়টা ছিলো রাত। অন্ধকারের কারণে কিছুই দেখা হয়ে উঠেনি।
আরেকটা বিষয়, আমি চাইলে বরকল থেকে সরাসরি লংগদু উপজেলায় খুব সহজে আসতে পারতাম। আসিনি, কারণ তখন পরিবারের সবাই ছিলো। রাতও হয়েছিলো অনেক। প্রস্তুতি থাকলেও রাতের বেলা সাহসে কুলুইনি। সেজন্য আবার এক ঘন্টা সময় অপচয় করে রাঙ্গামাটি সদরে এসে লংগদুর উদ্দেশ্যে বের হলাম। যথা সময়ে জাহাজ ছেড়ে দিলো। রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে লংগদু যেতে নাকি তিন ঘন্টা লাগে, হয়তো বরকল থেকে গেলে দুই ঘন্টা লাগতো। নতুন বিধায় কিছুই করার ছিলো না।
কিছু দূর আসতে না আসতে নদীর, অবশ্য নদী বললে ভুল হবে, ‘লেক’ বলাটা সমীচীন হবে। কারণ এখানে কোনো প্রকার জোয়ার-ভাটা হয়না। সারা বছরই পানি থাকে, হয়তো শুকোতে পারে। তবে পানি বছরের প্রায় সময় থাকে। যে জাহাজ পথ দিয়ে রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে সর্বশেষ বাঘাইছড়ি পর্যন্ত যাওয়া যায়, সেটা বাঙালিদের নিজেদের করে নিতে উপজাতিদের সাথে এক সময় তুমুল ঝগড়া ছিলো, সেটা নাকি মারামারি থেকে বন্ধুক যুদ্ধ পর্যন্ত গড়িয়ে ছিলো। পথটাতে বেশির ভাগ বাঙালিরাই আসা-যাওয়া করে। উপজাতি খুব কমই দেখা যায়। এখন তেমন একটা জাহাজ পথে ঝামেলা হয় না। যে যার মত পথটাকে ব্যবহার করে।
জাহাজে করে আসতে চার দিকের সৌন্দর্য আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। দুই পাশে পাহাড়, মাঝেমধ্যে লেকের পাশে চর, আবার পানির মাঝখানে দ্বীপ, সত্যিই অসাধারণ। পানির মধ্যে পানকৌড়ি, আর নানা প্রজাতির পাখি লেইককে করেছে সৌন্দর্যের লীলাভূমি। উপজাতিরা লেকে ছোট ছোট ছিপ ফেলে মাছ ধরে। এখানে জেলেদেরও দেখা যায়। তারা লেকে অবস্থিত অন্যের জমিতে জাল ফেলে মাছ ধরে, বিনিময় মাছের কিছু অংশ জমির মালিককে দেয়। লেকে জাল ফেলতে হলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে অনুমতিসহ স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়।
মাঝেমাঝে পানি কমে তৈরি হওয়া দ্বীপগুলোতে বাঙালিদের বসবাস করতে দেখা যায়। সেখানে অবশ্য উপজাতি কম থাকে। তারা বেশির ভাগ পাহাড়ের গভীর অরণ্যে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। আসার সময় একটা পাহাড়ে বৌদ্ধমূর্তি দেখতে পেলাম। অনেক দূর থেকে সে মূর্তিটাকে দেখা যায়। যতক্ষণ না লেকের বাঁক পরিবর্তন হচ্ছে, সেটা আবক্ষ মুর্তির মতো দিব্যি দাঁড়িয়ে থাকে। সেখান থেকে মনে হয় কাউকে আহ্বান করছে।
একটা দ্বীপে দেখলাম, কিছু কুকুরের বাচ্চা। দেখেই অবাক হলাম। দ্বীপের চার দিকে পানি অথচ কুকুর! একজনকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, হয়তো দ্বীপের মালিক দ্বীপটি পাহারাদার হিসেবে রেখে গেছেন। বললাম, তাও হতে পারে। আমি কখনো জাহাজে নিচে সিটে, আবার কখনো ছাদে চলে যায়। ছাদ থেকে সৌন্দর্যটা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। অবশ্য রোদ পড়া সত্ত্বেও বাতাসের কারণে শীতও অনুভব হয়, ফলে মাঝেমধ্যে চা পান করে একটু উষ্ণতা অনুভব করার চেষ্টা করি।
যাত্রা পথে কয়েক জন নিয়মিত যাত্রীর সাথে ভালোই আলাপ পরিচয় হয়। একজনের নাম সাজ্জাদ, সে একটি মাদ্রাসায় দশম শ্রেনিতে পড়ে। রাশেদ, সম্প্রতি ডিগ্রী শেষ করেছে। মামুন, বয়স বিশোর্ধ্ব হবে একজন জেলে, বর্তমানে চাকরিজীবী। সে একটা জাহাজে কাজ করে। আরো তিন-চার জন ছিলো, নামগুলো ঠিক মনে নেই। আলাপটা খুব জমে গিয়েছিল। সম্পর্কের একটা বন্ধন তৈরি হয়ে গেলো। এরই মধ্যে মুঠোফোনের নাম্বারও দেয়া-নেয়া হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগেও দুই জন যুক্ত হয়ে গেছে।
বিদায়ের মুহূর্ত, জাহাজের কেরানি এসে ভাড়ার কথা বললেন। ভাড়াটা কম-বেশি নির্ভর করে জাহাজে আপনার অবস্থান অনুযায়ী। যদি গ্যালারিতে বসেন, তাহলে এক রকম আর পাটাতনে দাঁড়ালে অন্য রকম। জাহাজের ছাদে যাত্রী নেয়া বারণ। বারণ না মেনে আমাদের মতো নতুন অভিজ্ঞতা সম্পন্নকারী কিছু যাত্রী ছাদে উঠে যায়। আমি গ্যালারীতে সিট নিলেও পাটাতন ও ছাদেই বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছি, ফলে ভাড়াটা কম আসার কথা। কিছুই করার নেই, যেহেতু গ্যালারীতে নিশ্চিত করেছি, সেহেতু নির্দিষ্ট ভাড়াই পরিশোধ করতে হবে। রাঙ্গামাটি সদরের রিজার্ভ বাজার থেকে লংগদু ১৩০ টাকা ভাড়া নির্ধারিত হয়।
অবশেষে তিন ঘন্টা সময় পর আমি লংগদু ঘাটে এসে পৌঁছায়। সঙ্গ দেয়া যাত্রীদের থেকে বিদায় নিয়ে লংগদু ঘাট থেকে গন্তব্যস্থলে আসার প্রন্তুতি নিই। তখন সময়টা দুপুর একটা।
(চলবে)