মোস্তফা কামাল যাত্রা: পূর্ববঙ্গে বিদ্যায়তনিক নাট্যশিক্ষা যাঁর তত্ত্বাবধানে সূচিত হয়েছিল; সেই কবি জিয়া হায়দারের জন্ম হয়েছিল পাবনার দোহারপাড়াস্থ পৈত্রিক বাড়ীতে।১৯৩৬ সালের ১৮ নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতার নাম মো. শেখ হাকিম উদ্দিন আর মাতার নাম রহিমা খাতুন। জিয়া হায়দার পিতামাতার তৃতীয় সন্তান হলেও ভাইদের মধ্যে ছিলেন জেষ্ঠ।
পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন; পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে আইএ; রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্স এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষা সাহিত্য বিষয়ে এমএ সম্পন্ন করে সেই বছরই নারায়ণগঞ্জের তোলাবাম কলেজে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন সমকালীন সনামখ্যাত কবি ও সাংবাদিক জিয়া হায়দার।
শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার পূর্বে ছাত্র অবস্থায় জিয়া হায়দার সাপ্তাহিক পল্লীবার্তা, সাপ্তাহিক চিত্রালী এবং দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তবে ১৯৬৩ সালে সহকারী সাংস্কৃতিক অধিকর্তা হিসেবে তিনি ঢাকাস্থ তৎকালীন বাংলা একাডেমিতে যোগ দিলেও একজন বাঙ্গালী হিসেবে সর্বপ্রথম নাট্যকলা বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ গ্রহণের জন্য শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ১৯৬৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হাওআই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যকলায় এমএফএ ডিগ্রি শেষ করেন।
জানামতে, তিনি ভারতবর্ষের প্রথম কোনো বাঙালি; যিনি বিদেশভূমে নাটক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্নকারী ব্যক্তি। দেশে ফিরেই ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়।’ ১৯৬৯ সালের শুরুতে ঢাকা টেলিভিশনে সিনিয়র প্রোডিউসার হিসেবে যোগদান করলেও শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসানের অনুরোধে ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে নাট্যতত্ত্বের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে চবির বাংলা বিভাগে নাট্যতত্ত্বের শিক্ষক হিসেবে জিয়া হায়দারের নিযুক্তির মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গে বিদ্যায়তনিক নাট্যকলার আনুষ্ঠানিক পাঠ পক্রিয়া শুরু হয়। যদিও সেই পাঠ্যক্রম ছিল মূলত তাত্ত্বিক। বাংলা বিভাগের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত নাটকসমূহ তাঁর তত্ত্বাবধানে পঠিত হত।
১৯৭০ সালে নাট্যকলাকে প্রায়োগিক বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে জিয়া হায়দারের নেতৃত্বে চবির চারুকলা বিভাগের একটি শাখা হিসেবে নাট্যকলা প্রায়োগিক বিষয় হিসেবে পঠিত হতে আরম্ভ হয়েছিল। চারুকলা বিভাগের একটি শাখা হিসেবে নাট্যকলা সেই পাঠ্যক্রম ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে বাংলা বিভাগ, ইংরেজী বিভাগ এবং চারুকলা বিভাগের অপর শাখা চিত্রকলা বিষয়ে শিক্ষার্থীগণ নাট্যকলা বিষয় হিসেবে পড়তে পারতো। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে নাট্যকলায় এমএফএ কোর্স এবং ১৯৯১-১৯৯২ শিক্ষাবর্ষে স্মাতক এবং ১৯৯৪-১৯৯৫ শিক্ষাবর্ষে স্মাতকোত্তর কোর্স চালু হয়েছিল জিয়া হায়দারের তত্ত্বাবধানে। ২০০২ সালে তিনি নাটক ও নাট্যতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে চারুকলা বিভাগ থেকে অব্যাহতি নেন।
জীবদশায় অধ্যাপক জিয়া হায়দার ১৯৭৮ সালে নাটকে বাংলা একাডেমি সম্মাননা; ১৯৯৬ সালে লোকনাট্য স্বর্ণপদক এবং ২০০১ সালে সাহিত্যে একুশে পদক পুরষ্কার পান। নাট্যকলা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে নাট্যবিষয়ক একাডেমিক গ্রন্থ অনুবাদের পাশাপাশি তিনি মঞ্চ, বেতার ও টেলিভিশনের জন্য প্রায় অর্ধশত নাটক লিখেছিলেন। যার মধ্যে ‘থিয়েটারের কথা’ শিরোনামে বিশ্বনাট্যের ইতিহাস ও গতি-প্রকৃতি নিয়ে রচিত পাঁচ খন্ডের প্রকাশনা একটি আকর গ্রন্থ।
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে মঞ্চ, বেতার ও তথকালীন টেলিভিশনে নাটক প্রযোজনা করলেও; স্বাধীনতা উত্তর নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের মাধ্যমে যে দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী আয়োজনের সূত্রপাত হয়েছিল; তাঁর রূপকার ছিলেন জিয়া হায়দার। তিনি ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সভাপতি হিসেবে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিয়ে নাট্য সংগঠন হিসেবে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের স্বাতন্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
প্রাশ্চাত্য ও প্রাচ্য ধারার নাটক প্রযোজনার মাধ্যমে নাট্যশিল্পের বৈশ্বিক সীমানাকে অতিক্রম করেছিল ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়।’ যার নেপথ্য পুরুষ নাট্য শিক্ষক জিয়া হায়দার। তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাট্যক্রিয়া পরিচালিত হলেও তাঁকে অবহিত না করেই ১৯৮২ সালে তাঁর অনুপস্থিতিতে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়েছিল।
রহস্যজনক সেই নাট্যসন্ত্রাস আমৃত্যু জিয়া হায়দারের কাছে ছিল তুষাগ্নি। প্রসংগটি উঠলেই মূখমন্ডল মলিন হয়ে যেত তাঁর। অশ্রু সজল হয়ে পড়তেন তিনি।
সন্তানতুল্য ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ থেকে প্রাপ্ত এমন অপ্রত্যাশিত আচরণ জিয়া হায়দারকে করেছিল ব্যাথাতুর। আমৃত্যু তিনি সেই শোক বহন করে চলেছিলেন। ২০০৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
মৃত্যুর পূর্বেই জিয়া হায়দার তাঁর সংগৃহীত দেশি বিদেশী গ্রন্থাবলী ঢাকা ও জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়স্থ নাট্যকলা বিভাগে দান করেন। সেই সাথে সারা জীবনের আর্থিক সঞ্চয় দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিয়া হায়দার শিক্ষাবৃত্তি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মা-বাবার নামে ‘রহিমা-হাকিম’ শিক্ষাবৃত্তি প্রদানের জন্য উইল করে দিয়ে যান। যদিও উভয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত উল্লেখিত শিক্ষাবৃত্তিদ্বয় প্রদানের উদ্যোগ নেয়নি। এই প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টজনদের বিনীত মনোযোগ আকর্ষণ করছি। যেন প্রতি বছর জিয়া হায়দার কর্তৃক দেয় শিক্ষা বৃত্তিদ্বয় তাঁর জন্ম বা মৃত্যুদিবসে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয় এবং বৃত্তিদ্বয় নিয়মিতভাবে প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে প্রাসঙ্গিকক বাঁধা দূর হয়।
জিয়া হায়দারের মৃত্যু পরবর্তী (৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত শোক সভায় তাঁকে ‘নাট্যযুধিষ্ঠির’ অভিধায় অবিহিত করা হয়েছিল। যা তাঁর জন্য যর্থাথ বিশেষণ হলেও যখন দেখি তাঁরই প্রতিষ্ঠিত নাট্য সংগঠন ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ তাঁকে নিয়ে বিশেষ কোন আয়োজনের উদ্যোগ আজ পর্যন্ত নেয়নি; তখন প্রশ্ন জাগে- জীবিত জিয়া হায়দার থেকে মৃত জিয়া হায়দার বোধ হয় আরো প্রজ্ঞাবান।
সেই সাথে বিস্মিত হই যখন দেখি দলগত সিদ্ধান্তহীনতা আর পলায়নপর প্রবৃত্তির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে- নাট্যবিষয়ক মোর্চ্চাসহ নাট্যসংশ্লিষ্ট সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রবণতায়। গোষ্ঠিগত পৃষ্ঠপোষকতার বেড়ী জিয়া হায়দারের নাট্যকৃর্তিকে কাহাতক আবদ্ধ করে রাখবে?
ইতিহাস বড়ই নির্মোহ ও নিমর্ম। ১৮ নভেম্বর ২০২০; নাট্যযুধিষ্ঠির জিয়া হায়দারের ৮৪তম জন্ম জয়ন্তী। গোষ্ঠিগত চিন্তায় আবদ্ধ নয়- এমন নাট্যামোদীদের সক্রিয় উদ্যোগ ‘বাঙ্গময় করে তুলবে- জিয়া হায়দারের নাট্য সৃষ্টির প্রভাবকে” এই প্রত্যাশায় ইতি টানছি।
(নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা নাট্যযুধিষ্ঠির জিয়া হায়দারের ৮৪ তম জয়ন্তী স্মরণে)
লেখক:
অতিথি শিক্ষক, নাট্যকলা বিভাগ, চবি
এই নাট্যসন্ত্রাস সম্বন্ধে জানতে পেরে খারাপ লাগছে। স্যারকে প্রথম সরাসরি দেখেছিলাম কফিনে শায়িত অবস্থায়। তবে তার লেখা বইয়ে তিনি ছিলেন পূর্ব পরিচিত এবং সম্মানের দাবিদার। একটা তথ্য নির্ভূল হওয়া প্রয়োজন আর তা হলো আমি নিজেই ঢাবি তে সম্মানে ভালো ফলাফল করায় জিয়া হায়দার স্মারক বৃত্তি অর্জন করেছি। এই তথ্যবহুল লেখনীর জন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।
নাট্যকলার প্রখ্যাত অধ্যাপক, নাগরিকের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শ্রদ্ধেয় জিয়া হায়দার-এর ছিল চট্টগ্রামের প্রথম গ্রুপথিয়েটার ”থিয়েটার ‘৭৩”-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এই সংগঠনটি তাঁর লেখা ও নির্দেশনায় অন্তত দুটি নাটক চট্টগ্রামে মঞ্চস্থ করেছিলো। এর মধ্যে তাঁর রচিত একটি নাটক(‘এলেবেলে’) ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত নাট্যোৎসবে সুপ্রযোজনার জন্য পুরস্কৃত হয়। উল্লেখযোগ্য এসব তথ্য এই লেখায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিলো। তবু রচনাটি ভালো হয়েছে। লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
জিয়াউল হাসান কিসলু।
মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও অভিনয়শিল্পী। (ঢাকা, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)