ডাক্তার মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ: রমজান মাসে প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেক নর-নারীর জন্য রোজা রাখা ফরজ। কিন্তু এ ফরজ কাজটি করতে গিয়েই বেশির ভাগ সময়ই বেশ অসুবিধায় পড়ে যান ডায়াবেটিস রোগীরা। কারণ এ সময় পরিবর্তন করতে হয় তাদের খাদ্যাভাস ও ওষুধের সময়সূচি। আর পরিবর্তনের কারণে তাদের শরীরের ক্যালরি এবং ওষুধের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা দেখা দেয়। এতে করে রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে আবার কমে যেতে পারে। আর ঠিক এ কারণেই রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য ডায়াবেটিসের রোগীদের আগে থেকেই পূর্ব-প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ দরকার।
রোজায় ডায়াবেটিস রোগীরা যে ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়: রোজার কারণে ডায়াবেটিক রোগীদের নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিভিন্ন সমীক্ষায় থেকে জানা গেছে, রমজান মাসে ডায়াবেটিক রোগীদের শরীরে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকায় পানিশূন্যতাই এর মূল কারণ। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় অতিরিক্ত প্রস্রাবের কারণে শরীরে পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে। সেই সাথে শরীরে ইলেকট্রোলাইটের পরিমাণও কমে যেতে পারে। ফলে ব্লাড পেশার কমে গিয়ে অজ্ঞান হওয়া, পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া, হাড় ভেঙ্গে যাওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
রমজানে ডায়াবেটিস রোগীদের করণীয়: সর্ব প্রথম প্রস্তুতি হিসেবে ডায়াবেটিস রোগীদের জেনে নেওয়া উচিত তাদের শরীর রোজা রাখার জন্য উপযুক্ত কি না। শরীরে যদি শর্করার মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত থাকে অর্থাৎ তিন মাসের মধ্যে মারাত্মক হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা শর্করাস্বল্পতা, কিটোঅ্যাসিডোসিস বা শর্করার মারাত্মক আধিক্য থাকে, তাহলে রোজা রাখা উচিত নয়।ডায়াবেটিস ছাড়াও অন্য শারীরিক সমস্যা যেমন যকৃতের সমস্যা, হৃদরোগ ও কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত হলেও রোজা না রাখাই ভালো। এ তালিকায় অবশ্য গর্ভবতী ডায়াবেটিস রোগী ও ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন এমন রোগীরাও পড়বেন। অন্যদের মধ্যে যারা কেবল খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমেই শর্করা নিয়ন্ত্রণ করছেন বা মেটফরমিন, ডিপিপি ৪ ইনহিবিটর বা গ্লিটাজন শ্রেণীর ওষুধ খান, তাদের রোজা রাখা বেশ নিরাপদ। যারা ইনসুলিন বা ওষুধ ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই নতুন করে ওষুধের মাত্রা ও সময় জেনে নিতে হবে। এছাড়া খাবারের পরিমাণ হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্যাভ্যাস: রমজান মাসে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্যালরির চাহিদা আগের মতই থাকবে। এ সময় শুধুমাত্র খাবার গ্রহণ ও সময়ের কিছুটা পরিবর্তন হবে। ইফতারে বিকল্প চিনি দিয়ে ইসবগুলের ভুষি, তোকমা, লেবু, কাঁচা আম বা তেঁতুল শরবত এসব রোগীদের জন্য উপকারী। ডাব ছাড়া অন্য মিষ্টি ফলের রস না খাওয়াই ভালো। তবে টক ও মিষ্টি উভয় ধরনের ফলের সালাদ খাওয়া যেতে পারে। এতে খনিজ লবণ ও ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ হবে। এছাড়া, কাঁচা ছোলার সঙ্গে আদাকুঁচি, টমেটো কুঁচি, পুদিনা পাতা ও লবণের মিশ্রণ খাওয়া যাবে। কাঁচা ছোলা রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। সন্ধ্যা রাতে (ইফতার পরবর্তী) খাবার একেবারে বাদ দেওয়া উচিত নয়। অবশ্যই কম করে হলেও খেতে হবে। অন্য সময়ের রাতের খাবারের সমপরিমাণ হবে রমজানে ডায়াবেটিস রোগী খাবার। রোগী ভাত খেতে পারবে তবে চিকিৎসক কর্তৃক বরাদ্দ খাবারের পরিমাণের দিকে সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। হালকা মসলায় রান্না, যে কোন ছোট-বড় মাছ এবং সবজি নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে।সেহরিতে (ভোররাতের খাবারে) রুটি অথবা ভাত নিজের রুচি অনুযায়ী গ্রহণ করুন। সেহরির খাবারের পরিমাণ হওয়া উচিত অন্য দিনের দুপুরের খাবারের সমপরিমাণ। সেহরিতে মাছ ও সবজি থাকতে পারে। দুধ অথবা ডাল যে কোন একটা থাকলে ভালো হয়। ইফতারে এক সঙ্গে বেশি না খেয়ে অনেক খাবার ধাপে ধাপে ভাগ করে খান। এতে রক্তে হঠাৎ করে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাবে না।
ওষুধ ও ইনসুলিন: রমজান মাসে খাবারের সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হবে ওষুধ এবং ইনসুলিনের মাত্রা ও সময়সূচিরও। আর অবশ্যই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে দিনের ওষুধগুলোর সময় পরিবর্তন করে রাতে তা গ্রহণ করতে হবে। কারণ ওষুধের মাত্রা রক্তে শর্করার পরিমাণের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। আর ঠিক এ কারণে নিজ থেকেই ওষুধের সময়সূচি পরিবর্তন করা যাবে না। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ব্যায়াম: এটা সকলেই জানেন যে, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ব্যায়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এদের মধ্যে যারা প্রতিদিন একটা নিয়ম করে ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটি করেন। এ মাসে অবশ্যই তাদের সে রুটিনেও পরিবর্তন আনতে হবে। রোজা রেখে ব্যায়াম ও খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করা যাবে না। তবে ইফতারের এক ঘণ্টা পর ও সেহরির আগে ব্যায়াম করতে পারেন।
সর্তকতা: ডায়াবেটিসের সঙ্গে যাদের অন্য কোন জটিলতা, যেমন- কিডনির রোগ, উচ্চমাত্রার ইউরিক থাকলে ডালের তৈরি খাবার থেকে বিরত থাকুন। আলসার বা গ্যাসট্রাইটিসের সমস্যা থাকলে ডুবো তেলে ভাজা ও ঝাল যুক্ত খাবার অবশ্যই পরিহার করুন। শরীরের ওজন বেশি থাকলে যতটা সম্ভব কম খাবার গ্রহণ করুন এবং খাবারে তেলের পরিমাণ কমিয়ে দিন। রোজা রেখে অত্যধিক হাঁটা বা ভারী ব্যায়াম থেকে বিরত থাকুন। কারণ এতে আপনার শরীরে রক্তের শর্করার মাত্রা নিচে নেমে গিয়ে বিপদ হতে পারে। রমজানে অবশ্যই ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরের প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত। কারণ শরীর সুস্থ না থাকলে এসব রোগীর জন্য রোজা রাখা অনেক সময় নিরাপদ নাও হতে পারে।
হোমিওপ্রতিবিধান: রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। এ জন্য অভিজ্ঞ হোমিওচিকিৎসকে রোগীর পুরা লক্ষণ নির্বাচন করে ধাতুগত চিকিৎসা দিতে পারলে তাহলে আল্লাহর রহমতে হোমিও চিকিৎসায় দেয়া সম্ভব। প্রাথমিকভাবে যে সব মেডিসিন অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা নির্বাচন করে থাকে এব্রোমা আগষ্ট, সেফালান্ডা ইন্ডিকা, সিজিজিয়ম, এসিড ফস, আর্সেনিক ব্রোমাইড, এসিড ল্যাকটিক, ইউরেনিয়ম নাইট, নাক্স ভূমিকা, এসিড এসেটিক, ক্যালকেরিয়া ফসসহ আরো অনেক ওষুধ লক্ষণের উপর আসতে পারে।
তাই অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া মেডিসিন নিজে নিজে ব্যবহার করলে রোগ আরো জটিল আকারে পৌঁছতে পারে। তাই শরীর সুস্থ রাখতে দৈনন্দিন খাবারের ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে ডায়াবেটিস রোগীদের।
লেখক: কো-চেয়ারম্যান, হোমিও বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র