রাত যত গভীর হচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্য ঠিক ততটাই অন্ধকারের সাজে নিজেকে ডুবিয়ে নিচ্ছে। বইয়ের ভাজ থেকে চোখ বাহিরে নিতেই রীতিমত এক ধাক্কা খেলাম। ধাক্কাটা ঠিক জানলার সাথে নয়, খেলাম নিঝুম ঘুমন্ত পরিবেশটার সাথে। ঘন অন্ধকার ঝি ঝি পোকার ডাক, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, চলন্ত ট্রেনের ঝিক ঝিক আওয়াজ কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে……………….।
তরকারীতে লবণ ছাড়া স্বাদ যেমন অভিন্ন ঠিক তেমন করে ল্যাম্প পোস্টের আলো ছাড়া আধারের সৌন্দর্য খানিকটা অপূর্ণ।
-রাতের আকাশের বিমূঢ় সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হঠাৎ করে নিখোঁজ হওয়া মানুষটার খোঁজ পেয়ে গেলে তেমন একটা মন্দ হত না, তাই না?
গলা খাকড়ি দিয়ে বললেন সামনে বসে থাকা আগন্তুক।
কেবিনে হঠাৎ করে এমন কণ্ঠস্বর শুনে খানিকটা হতবিম্ব না হয়ে পারলাম না।
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১২টা বেজে ৩৩ মিনিট। এত রাতে কেবিনে অচেনা অজানা একটা লোক হুট করে কোথা থেকে কেমন করে আসল এসব প্রশ্ন অজান্তেই মনে নাড়া দিতে শুরু করল।
বেশ কড়া গলায় ওয়েটিং বয়কে ডাক দিলাম….
বেচারা ওয়েটিং বয় এতক্ষণে দীর্ঘ প্রচেষ্টা শেষে
মুখের গড়ন দেখতে পেয়েছে এটাই অনেক।
ওয়েটিং বয় রুমে এসেছিল ঠিকই তবে মেয়েটির কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারছিল না।
উত্তর না পেয়ে মেয়েটি বেশ রেগে গিয়ে বলল- কেবিনটা ভাড়া নেয়ার সময় বলা প্রয়োজন ছিল আপনাদের, মধ্য রাতে কেবিন কোন অজানা অচেনা ব্যক্তির সাথে হুট করে শেয়ার করতে হবে..।
ওয়েটিং বয় মাথা নিচু করে বেশ ভয়ার্ত অবস্থায় কাপা হাঁটু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ চোখ পড়ল সামনের সিটে বসা থাকা আগন্তুকের দিকে।
অদ্ভুত লোক তো, এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কেন আছে? আর ওইভাবে মুচকি হাসার কি আছে?
ওয়েটিং বয়কে চলে যেতে বলে সামনে বসে থাকা আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় জানতে চাইলাম – অমন হা করে তাকিয়ে কি দেখে মুচকি হাসছেন, শুনি?
-হা হা হা হা (বেশ জোরালো গলায় হেসে উঠল), এলোমেলো অগোছালো চুলে আপনায় বেশ সুন্দর লাগছে….।
অদ্ভুত লোক তো আপনি, কে আপনি জানতে পারি?
-আপাতত আমি আপনার কাছে এখনো অপরিচিত একজন, এটাই পরিচয় আমার।
এমন প্রশ্নের জটিলতা উত্তর পেয়ে আর ইচ্ছে করছে না একে কোনো প্রশ্ন করি…
সাদা ধূতি আর পাঞ্জাবির উপর ধূসর রঙের চাদর গায়ে জড়িয়ে হাতে এক খানা পুস্তক রেখে চোখে বাদামি রঙের বেশ চড়া ফ্রেমের গোল চশমা পরা অবস্থায় অনেকটা কেবলাকান্ত লাগছিল।
হুট করে খানিকটা গলা ঝেড়ে নিয়ে, ভদ্রলোকটা বললো– মহাশয়া কি আমায় কিছু বলছেন?
হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে বিচলিত অবস্থায় বললাম- আজ্ঞে, কই নাতো..!
লোকটি এবার মৃদু হাসি দিয়ে বলল- মহাশয়া আমায় কেবলাকান্ত বা কমলাকান্ত যাই বলুন না কেন, দুটোর একটাও আমি নই।
রীতিমত আমি খুব হবাক হলাম, আমি যে মনে মনে তাকে কেবলাকান্ত বলেছি, সেটা কি করে বুঝলেন?
-মহাশয়ার বড্ড গরম লাগছে, মনে হচ্ছে।
চোখ বড় করে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বললাম- আমার গরম লাগছে, তা কি একবারো বলেছি আপনায়?
-ঠিক তা নয়, আসলে পরিবেশের তাপমাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে তো, তাই আর কি একটু আধটুকু খোঁজ খবর রাখা……. (বলেই মুচকি হাসতে শুরু করল)
উফফ, এ তো ভারি জ্বালা। আচ্ছা, আপনি একটু চুপ করে বসে থাকুন না। কেউ কি মাথায় দিব্বি দিয়ে রেখেছে আপনায় যে কথা বলেই যেতে হবে?
-কথা বলার সময় কেপে উঠা আপনার জড়সড় ঠোঁট দিয়ে যখন স্পষ্ট ধ্বনি উচ্চারণ করেন, তখন আপনার চোখে মুখে লেগে থাকা রাগান্বিত ও বিরক্তিকর ভাবের সাথে বাহিরে থাকা আলো ছায়া খেলাবার মত একটা অদ্ভুত ভালো লাগা তৈরি করে (কথাটা বলেই খুব গভীরভাবে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে)
আগন্তুকের কাছে পাওয়া এমন উত্তর আমার জন্য খানিকটা আশ্চর্যজনক ছিল। কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর হচ্ছে নিজের ভিতর। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে নিজের অজান্তেই। কত বার যে ঢুক গিলেছি তার হিসেব নেই। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জানালা দিয়ে বাহিরে আকাশের দিকে তাকিয়ে এক মনে কত কি ভেবে যাচ্ছি নিজেও জানি না…..
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটছিল দুজনের। হঠাৎ নীরবতা ভেঙ্গে দিয়ে লোকটি প্রশ্নের তীর ছুড়ে দিয়ে জানতে চাইলো- অনধিকার চর্চা পছন্দ না করা মেয়েটির মাঝে আজ কোন অজানা মানুষকে নিয়ে সেই গুণ দেখতে পাওয়া অবাক করার মতো নয় কি?
(চলবে..)