ঢাকাবৃহস্পতিবার, ২৩শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ধারাবাহিক উপন্যাস: ‘সোনারগাঁ’ । পর্ব এক

সেলিম ইসলাম খান
ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১ ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

রাত্রি দ্বিপ্রহর। জোছনা ধোয়া আকাশ। গাঙে টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। গঙ্গা থেকে পদ্মায় পড়ল একটি বজরা নৌকা। আরোহী পাঁচজন। ভগীরথ, গীতারানী, দশরথ, লক্ষীরানী আর কালিদাস। দাঁড় বাইছিল দুজন মাল্লা। রাতের নির্জনতা ভেঙ্গে দাঁড়ের শব্দে গাঙের জলে চপচপ শব্দ হচ্ছিল। মাঝিদের মাথায় বাঁশের বেতের তৈরি মাথাল। ক্ষণে ক্ষণে তারা জোছনা ছড়ানো চাঁদের পানে চেয়ে নিজেদের ক্লান্তি দূর করছিল। মাঝিদের একজন ভোলা অন্যজন মতি। তারা দুজনেই লখনৌতির বাসিন্দা। গাঙে মাছ ধরে আর খেয়াপারাপার করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে।

ভোলা: মতি! আইজ রাইতের বায়ে খুব ঝার পড়ছে। মনে অয় ঝারের দিন আইতে আছে। ঝাড়ে নদীর জল ভয়ানক অয়ে যায়। তুই তো বেশ গীত পারিস। একটা গীত গা না।
মতি: গীত তো গাইব ভোলা! জোছনা আমারে উদাস করছে। এমুন চাঁন্দের আলো আমি জীবনে দেহি নাই।

মতি গীত ধরে, ‘ও আমার জোছনা রাইতের চান্দ, তুমি একূল ওকূল দুইকূলে মোর মনখানিরে বান্ধ (তুমি) আমি নিরলে বসিয়া ভাবি একি অবাক কান্ড।।
এই কূলে মোর পরান থাকে, ওই কূলেতে জান। জানপরানে মিইলা করে আমারে খানখান। (বায়রে)
একে ডাকে ইশারাতে অন্যে ডাকে হাতছানিতে। তাদের ডাকে আমি ব্যাকুল, হয়ে যাই রে দ্বান্ধ।
ও আমার জোছনা রাইতের চান্দ, তুমি একূল ওকূল দুইকূলে মোর মনখানিরে বান্ধ (তুমি)।
গৌড় হইতে পান্ডিয়াতে নৌকা বাইরে দিনে রাইতে, তবু মন যমুনায় আমি না ‘রি বাইতে।
তোমার রূপে ঘিরে ধরে, আমারে নি উদাস করে, তুমি আমার লায়লা আরজুমান্দ।।

গীতারানী আর লক্ষীরানী এক মনে গীত শোনে। এই বিদেশ বিভূঁইয়ের ভাষা তারা কতক বোঝে, কতক বোঝে না। কিন্তু মাঝির গানের সুর তাদের মনে আনন্দের হিল্লোল তোলে। ছোট কালিদাস চঞ্চলতা দিয়ে তাদের নিবিষ্টতা ভাঙ্গে।

কালিদাস: বাজান! এই মাঝি কি গীত গায়?
ভোলা: ক্যান বাবা! গীত তোমার ভাল লাগেনি নাকি?
কালিদাস: ভাল লাগছে, কিন্তু কিছু বুঝি নাই।
ভগীরথ: ওটা গাঙের গীত বাবা! নাও বাইতে বাইতে মাঝিরা এই গীত গায়।
কালিদাস: আমিও এই গাঙের গীত শিখব বাবা।
ভগীরথ: শিখবে বাবা! বিলকুল শিখবে। আমরা আগে সুবর্ণ গ্রাম যাই। সেখানে বসতি গড়ি। তারপর তুমি এই গীত শেখার অনেক সুযোগ পাবে বাবা।

ভগীরথ ও দশরথদের বেশভূষার আভিজাত্য দেখে মাল্লারা বেশ ইতস্ত করলেও এই সুযোগে ভোলা মনের গোপন জিজ্ঞাসা প্রকাশ করল: দাদা কোন দেশ থেকে এলেন? আগে কি সুবর্ণ গ্রাম গিয়েছিলেন?
ভগীরথ: আমরা এসছি দিল্লী থেকে। দশরথ আমার ছোট ভাই আর কালিদাস আমার ছেলে।সুবর্ণ গ্রামে আমরা আগে আসি নি। তবে আমার বন্ধু ফিরোজের কাছে সুবর্ণ গ্রামের অনেক সুনাম শুনেছি। সুবর্ণ গ্রামের পসরার খাতির সিন্ধু ও পারস্য থেকে আরব দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। আমার ইচ্ছে সেখানে পসরার বাণিজ্য করব।
ভোলা: আপনারা তো বেশ দূর থেকে এসেছেন। লখ্যা নদীর তীরে সুবর্ণ গ্রাম বঙ্গ দেশের সবচে’ বড় নগর। আমরা লখনৌতি থেকে প্রায়ই এখানে আসি। মাঝে মাঝে পসরার বাণিজ্যও করি। ইলিশের মওসুমে নদীতে ইলিশ ধরি।
ভগীরথ: এই গাঙের ইলিশের সুনামও অনেক। এখন কি ইলিশ পাওয়া যায়?
ভোলা: ইলিশের মওসুম শেষ হয়েছে। তবে এখনো কিছু কিছু ইলিশ ধরা পড়ছে। বিক্রমপুরে গিয়ে আপনাদের কিছু ইলিশ কিনে দেব। তেল দিয়ে ঝাল করে রান্না করলে ইলিশের মত মজা আর কিছুতে পাওয়া যায় না।
ভগীরথ: আমার বন্ধু ফিরোজ আমাকে বেশ কয়েক বার ইলিশ খাইয়েছে। এত ভাল স্বাদ আমি অন্য মাছে পাই নি।
মতি: শুধু ইলিশই না, এই গাঙের দেশে সম্পদের শেষ নাই। কোনো কিছুর অভাব নাই।

(চলবে….)

Facebook Comments Box