চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের সরকারি শিশু পরিবারে বেড়ে ওঠা অভিভাবকহীন তিন কন্যার জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের অভিনব আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত সরকারি শিশু পরিবারের তিন কন্যা মর্জিনা আকতার (২২), মুক্তা আকতার (২০) ও তানিয়া আকতারের (২০) শুভ বিবাহ আয়োজনটি বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) রাতে চট্টগ্রাম অফিসার্স ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিয়ের দাওয়াত পাঠানো হলে তিনি তিন কন্যার জন্য দোয়া করেন ও বিবাহ-পরবর্তী জীবন স্বাচ্ছন্দে নির্বাহ করার জন্য উপহার হিসেবে স্বর্ণালংকার পাঠিয়েছেন। মহতি এ উদ্যোগ নেয়ায় তিনি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানান ও সমাজের সবাইকে সামর্থ্য অনুযায়ী এ ধরনের কাজে অংশ নেয়ার আহবান জানান।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তিন বোনের প্রত্যেককে দুই ভরি করে মোট ছয় ভরি স্বর্ণালংকার ও দুই লাখ টাকা করে মোট ছয় লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিটের ব্যবস্থা করেছে । এ ছাড়া তিন যুগলকে একটি করে ফ্রিজ ও টিভিসহ দৈনন্দিন জীবনের সব প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও সারঞ্জাম যেমন খাট, আলমিরা, ড্রেসিংটেবিল, ফ্যান ও রন্ধনসামগ্রী দেয়া হয়েছে। তিন যুগলের এ বিবাহ অনুষ্ঠান স্মরণীয় করে রাখার জন্য আরো উপহার দেয়া হয়েছে বিয়ে ও হলুদের শাড়ী, স্যুট, ঘড়ি, পাঞ্জাবী, জুতোসহ যাবতীয় সামগ্রী।
সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত সরকারি শিশু পরিবার সমাজের পরিত্যক্ত ও অভিভাবকহীন শিশুদের আশ্রয় দিয়ে আসছে। পরবর্তী এ শিশুদের পিতা-মাতার পরিচয় পাওয়া গেলে তাদের যথাযথ অভিভাবক বরাবর ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে যারা অভিভাবকহীন থেকে যায়, সমাজসেবা অধিদপ্তর তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ভরণ-পোষণ ও পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়ে তাদেরকে স্বাবলম্বী করে তোলার ভার নেয়।
এমনই তিন শিশু মর্জিনা আকতার, মুক্তা আকতার ও তানিয়া আকতার সরকারি শিশু পরিবারের তত্বাবধানে পালিত হয়ে যথাক্রমে উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তিনজন বর্তমানে অ্যাটেনডেন্ট পদে চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত আছেন। আর অভিভাবকহীন এ তিন কন্যার জীবনকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য তাদের বিবাহ অনুষ্ঠানের উদ্যোগ আয়োজনে হাত বাড়ায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
১৯৯৭ সালে মাত্র ৪৫ দিন বয়সে কতোয়ালী থানার একজন উপ-পরিদর্শকের সাহায্যে সমাজসেবা কার্যালয়ে আসা মর্জিনা আকতার আজ জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেছেন চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে অফিস সহায়ক পদে কর্মরত মোহাম্মদ ওমর ফারুককে (২৯)। চার বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া ও তারপর আদালতের আদেশে ছোটমণি নিবাসে আশ্রয় পাওয়া মুক্তা আকতার গাঁটছড়া বাঁধেন চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কর্মরত মোহাম্মদ নুর উদ্দিনের (২৬) সাথে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে মায়ের মৃত্যুর পর দুই বছর বয়সী তানিয়া আকতারকে ২০০৩ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরে হস্তান্তর করা হয়। তানিয়ার অভিভাবকরুপে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পেশায় বিক্রয়কর্মী হেলাল উদ্দিনের (২৬) সাথে তার বিবাহ নির্ধারণ করে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এ মানবিক, অভিনব ও জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র, সাংসদ, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এছাড়া এ তিন কন্যাকে আশীর্বাদের জন্য উপস্থিত ছিলেন জাতির সূর্যসন্তান চট্টগ্রাম জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা। আরো ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। প্রায় এক হাজার অতিথির উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) রাত নয়টায় এ তিন কন্যার কন্যাদান সম্পন্ন করা হয়।
উল্লেখ্য, বিয়ের আয়োজনকে পরিপূর্ণতা দেয়ার জন্য বুধবার (১২ অক্টোবর) সন্ধ্যায় তিন কন্যার আবাসস্থল সরকারি শিশু পরিবার অঙ্গনে উৎসবমুখর হলুদ সন্ধ্যারও আয়োজন করা হয়।