ঢাকা: ইউক্রেনে ‘নজিরবিহীন মানবিক সংকটের’ পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে অতিরিক্ত অর্থ দেয়া সত্বেও রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশে সফররত ইউএসএআইডির ডেপুটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ইসোবেল কোলম্যান বুধবার (১১ মে) এ কথা বলেছেন।
ইসোবেল কোলম্যান তার পাঁচ দিনের বাংলাদেশ সফর শেষ করার আগে ঢাকায় আমেরিকান সেন্টারে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের সহায়তা অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
তিনি আরো বলেন, ‘মানবিক সহযোগিতার বিষয়ে আমরা নীতিগতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ ও নিশ্চিত করছি যে, এখানে শরণার্থীরা (রোহিঙ্গারা) মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সামগ্রী পাচ্ছে, যা আমাদের দিক থেকে অগ্রাধিকারের বিষয়।’
ইউক্রেনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অধিক গুরুত্বারোপের কথা উল্লেখ করে কোলম্যান বলেন, ‘মার্কিন কংগ্রেস ইতিমধ্যে ইউরোপীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অতিরিক্ত তহবিল দিয়ে সহযোগিতার কথা জানিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার সামরিক হামলা কার্যত বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের হুমকি ও বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি করেছে। আমেরিকানদের উদারতার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে অতিরিক্ত তহবিল দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইউএসএআইডি মার্কিন কংগ্রেসের সাথে যা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।’
ইসোবেল বলেন, ‘বিনা উস্কানিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট খাদ্য সংকট (বিশ্বব্যাপী) আমরা মোকাবেলা করতে পারি।’
কোলম্যান বলেন, ‘কক্সবাজার ও ভাসানচর দ্বীপ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সাথে তার আলাপে তিনি ধারণা পেয়েছেন যে, সব রোহিঙ্গা রাখাইনে তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে চায়, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন ঘটবে না।’
ইউএসএআইডির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি মনে করি না যে, আমরা অর্থপূর্ণভাবে কোন (রোহিঙ্গা) প্রত্যাবাসনের কোন সম্ভাবনা দেখতে পাব। (তবে) স্বেচ্ছায় (রোহিঙ্গা) প্রত্যাবাসনের জন্য আমাদের অবশ্যই আশাবাদী হতে হবে।’
তিনি বলেন, তার দেশ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’র যে নৃশংসতা চালিয়েছে, তা স্বীকার করার জন্য নেপিডোকে চাপ দেয়ার চেষ্টা করছে। একই সাথে মায়ানমারের সামরিক নেতাদের উপর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আশিয়ান সদস্য দেশগুলির সাথে কাজ করার জন্য চেষ্টা করছে।’
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (ইউএনএসসি) সংকট সমাধানে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে কিনা- এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য জিজ্ঞাসা করা হলে কোলম্যান বলেন, ‘বর্তমানে ইউএনএসসি ‘সবচেয়ে কার্যকরী’ সংস্থা নয়।’
তিনি বলেন, ‘অবশ্যই, আমরা দেখতে চাই যে, নিরাপত্তা পরিষদ বিশ্বের বিভিন্ন সংকটে আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে, কিন্তু বর্তমান (বৈশ্বিক) রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশেষ করে এ (রোহিঙ্গা) সংকটে ও অন্যান্য ইস্যুতে (ইউক্রেনসহ) তা করার সম্ভাবনা খুবই কম।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় এক দশমিক এক মিলিয়নেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে ও তাদের বেশিরভাগই মায়ানমারের সামরিক অভিযানের পরে এখানে এসেছে, যাকে জাতিসংঘ ‘জাতিগত নির্মূলের প্রকৃষ্ট উদাহরণ’ ও অন্যান্য অধিকার গোষ্ঠী এটিকে ‘গণহত্যা’ হিসাবে অভিহিত করেছে।
মায়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হলেও গত তিন বছরে একজনও রোহিঙ্গা দেশে ফেরত যায়নি।
কোলমেন পাইলট ভিত্তিতে মায়ানমারের পাঠ্যক্রমের আওতায় রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
তিনি অবশ্য বলেন, ‘বর্তমানে যে রোহিঙ্গা শিশু এ শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে, তাদের সংখ্যা খুবই নামমাত্র। যুক্তরাষ্ট্র আশা করে যে, সব বাস্তচ্যুত শিশু শিক্ষার সুযোগ পাবে, যাতে তারা বিশ্বের যোগ্য নাগরিক হতে পারে।’
কোলমেন আরো বলেন, ‘ভাষানচরের দূরত্ব, জীবিকার সুযোগের অভাব ও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য অপর্যাপ্ত মৌলিক সুযোগ-সুবিধার কারণে যুক্তরাষ্ট্রেরও কিছু উদ্বেগ রয়েছে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ কোস্টাল বেল্টের পাশাপাশি বেড়িবাঁধ নির্মাণে তহবিল দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধ সম্পর্কে কোলমেন বলেন, ‘বর্তমানে ইউএসএআইডি এ বিষয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য অর্থায়ন করছে।’
তিনি আরো বলেন যে, এটি ইউএসএআইডি নয়, বরং ইউএস ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোঅপারেশন (ডিএফসি), যা এ ধরনের বাস্তব কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে।’
তিনি বলেন, ‘শ্রম অধিকার নিয়ে উদ্বেগের কারণে ডিএফসিকে বাংলাদেশে কাজ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছিল ও ফলস্বরূপ এ সমস্যাগুলোর সমাধান না করা পর্যন্ত ডিএফসির পক্ষে প্রস্তাবিত বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব নয়।’
তিনি বাংলাদেশের উপকূলে বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে বলেন, ‘আমরা আশা করি যে, (বাংলাদেশ) সরকার সেই (শ্রম অধিকার) সমস্যাগুলো সমাধান করতে সক্ষম হবে ও আমাদের এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে। বাংলাদেশ সরকারও যত দ্রুত অগ্রসর হতে ইচ্ছুক, আমরা তত দ্রুত অগ্রসর হতে প্রস্তুত।’
তিনি সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতিতে বাংলাদেশের সাথে ইউএসএআইডির ৫০ বছরের অংশীদারিত্বের সাফল্যগুলোও তুলে ধরেন।
ইউএসএআইডির মিশন ডিরেক্টর ক্যাথরিন ডেভিস এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
ইসোবেল কোলম্যান ৭-১১ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করছেন ও তিনি এখান থেকে থাইল্যান্ড ও লাওস সফর করবেন।